হজ বা উমরাহ পালনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর সম্পন্ন করা। এই আমলটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে পালন করেছেন এবং তাঁর উম্মতের জন্য এটি সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সাত চক্কর বা সাঈ-এর প্রতিটি ধাপে আল্লাহর জিকির ও বিশেষ কিছু দোয়া পাঠ করা সুন্নত। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া সম্পর্কে।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া হলো এমন কিছু দোয়া, যেগুলো সাঈ করার সময় পাঠ করা সুন্নত বা মোস্তাহাব। এই দোয়াগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা, ও আত্মিক সংযোগের এক অনন্য উপলব্ধি হয়। সাঈ করার সময় প্রতিটি চক্করের মাঝে এই দোয়া পাঠ করে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা চাওয়া হয়। নিচে একটি দোয়া তুলে ধরা হলো, যেটি সাঈ-এর সময় বিশেষভাবে পাঠ করা হয়ে থাকে:
اِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللّٰهِ، أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللّٰهُ بِهِ
উচ্চারণ: “Innaṣ-Ṣafā wal-Marwata min sha’ā’irillāh, abda’u bimā bad’allāhu bih”
অর্থ: নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। আমি শুরু করছি সেই দিক থেকে যেটি আল্লাহ শুরু করেছেন।
এই দোয়া সাফা পাহাড়ে উঠার সময় পাঠ করা হয়। এরপর সেখানে কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করা উত্তম। মহানবী (সা.) সেখানে তিনবার তকবীর দিতেন এবং দোয়া করতেন।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া পাঠ করার পদ্ধতি
প্রথমে সাফা পাহাড়ে উঠে উপরোক্ত দোয়াটি পড়ে কিবলার দিকে মুখ করে হাত তুলে দোয়া করতে হয়। এরপর হাঁটতে শুরু করতে হয় মারওয়া পাহাড়ের দিকে। এই চলার পথে তাসবিহ, তাকবির, এবং অন্যান্য দোয়া পড়া যায়। অনেকেই নিচের এই দোয়াটি বারবার পাঠ করে থাকেন:
رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ إِنَّكَ أَنتَ الْأَعَزُّ الْأَكْرَمُ
উচ্চারণ: “Rabbighfir warham, innaka antal-A’azzu al-Akram”
অর্থ: হে আমার প্রভু! ক্ষমা করো ও দয়া করো, নিশ্চয়ই তুমি অধিক সম্মানিত ও মহান।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সাঈ এর মূল ইতিহাস হযরত হাজেরা (আ.)-এর সাথে জড়িত। তিনি যখন তাঁর শিশু ইসমাইল (আ.)-এর জন্য পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌড়ে বেড়িয়েছিলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা এই ঘটনাকে হজ ও উমরাহর অংশ হিসেবে নির্ধারণ করেন। তাই এই সাঈ একটি আত্মত্যাগ ও বিশ্বাসের প্রতীক।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া মূলত এই আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আস্থার গভীর বার্তা বহন করে। এই দোয়াগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের ইবাদতের গুরুত্ব উপলব্ধি করি এবং অন্তর থেকে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া কখন পড়তে হয়?
সাঈ-এর সময় মোট সাতটি চক্কর সম্পন্ন করতে হয়:
- সাফা → মারওয়া (১ম চক্কর)
- মারওয়া → সাফা (২য় চক্কর)
- সাফা → মারওয়া (৩য় চক্কর)
- মারওয়া → সাফা (৪র্থ চক্কর)
- সাফা → মারওয়া (৫ম চক্কর)
- মারওয়া → সাফা (৬ষ্ঠ চক্কর)
- সাফা → মারওয়া (৭ম চক্কর)
প্রত্যেকটি চক্করের শুরুতে বা মাঝপথে যে কোনো দোয়া, জিকির, বা কুরআনের আয়াত পাঠ করা যায়। তবে হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত নির্দিষ্ট দোয়াগুলো পড়া সর্বোত্তম। সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া পাঠের মাধ্যমে এই আমল আরও বেশি বরকতময় হয়ে ওঠে।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া মুখস্থ রাখা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যাঁরা হজ বা উমরাহ পালন করেন, তাঁদের জন্য সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া মুখস্থ রাখা অনেক উপকারী। কারণ-
- এটি সাঈ-এর সময় আত্মিক ধ্যান বজায় রাখে
- হজ ও উমরাহর সুন্নাত অনুসরণে সাহায্য করে
- নিজস্ব ভাষায় দোয়া করতে দ্বিধা থাকলে আরবি দোয়া আত্মবিশ্বাস দেয়
- দোয়ার মাধ্যমে একাগ্রতা ও খুশু বৃদ্ধি পায়
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য
অনেকেই মনে করেন দোয়া কেবল পুরুষদের জন্য। কিন্তু ইসলাম নারীদের ইবাদতের ক্ষেত্রেও সমান অধিকার দিয়েছে। হজ বা উমরাহ করতে গিয়ে নারী মুসল্লিরাও সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া পাঠ করতে পারেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে রহমত প্রার্থনা করতে পারেন।
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া শেখার সহজ উপায়
বর্তমানে অনেক হজ ও উমরাহ গাইড বই, ইউটিউব ভিডিও, মোবাইল অ্যাপস ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি সহজেই এই দোয়াগুলো শিখতে পারবেন। যাঁরা আরবি পড়তে পারেন না, তাঁদের জন্য বাংলা উচ্চারণসহ দোয়া শেখার মাধ্যমও রয়েছে।
উপসংহার
সাফা মারওয়া সাত চক্করের দোয়া শুধু কিছু শব্দ নয়, এটি হলো আত্মিক শুদ্ধি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি মহান উপায়। যারা হজ বা উমরাহ করতে যান, তাঁদের উচিত এই দোয়াগুলো আগেই শিখে নেওয়া এবং তা মনোযোগ সহকারে পালন করা। মনে রাখতে হবে, দোয়া হলো বান্দা ও আল্লাহর মাঝে একটি আত্মিক সেতুবন্ধন। তাই সাঈ-এর প্রতিটি ধাপে এই দোয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে পারি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি।